পড়াশুনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার

প্রযুক্তি হলো পদ্ধতি, দক্ষতা ও বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সমষ্টি যা মানবকল্যাণের জন্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরী ও ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তি আমাদের জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত, যা কখনো আমরা বুঝতে পারি কখনো হয়তো বুঝতেই পারি না যে আমরা প্রযুক্তির উপর কতটা নির্ভরশীল। প্রযুক্তি মূলত এমন কিছুর সমষ্টি যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের নানান সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন রূপ দিতে পারে। কম্পিউটার এর মাদ্ধমে শিক্ষা, অনলাইন পড়াশুনা, মোবাইলে ভিডিওর মাদ্ধমে পড়াশুনা শিক্ষার পদ্ধতিকে পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নয়নেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অ্যাসোসিয়েশন ফর এডুকেশনাল কমিউনিকেশনস অ্যান্ড টেকনোলজি (এ.ই.সি.টি.) এর মতে, প্রযুক্তির মাদ্ধমে পড়াশুনা হলো, উপযুক্ত প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া ব্যবহার ও পরিচালনা করে দক্ষতা অর্জন এবং দক্ষতা উন্নত করার উপায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার হলো প্রযুক্তিকে শিক্ষায় একীভূত করার প্রক্রিয়া যা একটি বৈচিত্র্যময় শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয় সেইসাথে তাদের সাধারণ দায়িত্বগুলি শেখার উপায়কে উৎসাহিত করে।

১। আত্মনির্ভরশীল পড়াশুনার মনোভাব তৈরী করে:
আগে আমাদের যখন কোনো কিছু জানার থাকতো বা কোনো প্রশ্ন থাকতো আমরা সাধারণত আমাদের বাবা মা অথবা আমাদের শিক্ষকদের সেই সম্পর্কে প্রশ্ন করতাম। কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন পরে না। হাতের মুঠোয় এখন সম্পূর্ণ বিশ্ব। চাইলেই জানা যায় যে কোনো তথ্য যে কোনো সময়। শিক্ষক কিংবা বড় কারো সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে শিক্ষার্থীরা এখন নিমিষেই খুঁজে পেতে পারে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য। কোথাও কোনো কিছু বুঝতে সমস্যা হলে এখন আর সাহায্য নিতে হয় না শিক্ষক কিংবা ক্লাস এর ভালো ছাত্রটির, নিজেই ইন্টারনেট এ ভিডিও দেখে শিখে নেওয়া যায় অনেক কঠিন কঠিন বিষয়। এভাবে পড়াশুনার মাদ্ধমে শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, কিছু শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছে প্রশ্ন করতে ভয় পায় অথবা ইতস্তত বোধ করে বলে কারো কাছে জানতে চায় না নিজের মনে লুকানো প্রশ্নের উত্তরগুলো। তাই না জানাই থেকে যায় অনেক কিছু। কিন্তু ইন্টারনেট হাত এ থাকলে এই সমস্যার সমাধান হবে এক মুহূর্তেই, সহজ উপায়ে ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বের করা যাবে জটিল সব প্রশ্নের সমাধান। এভাবে নিজে নিজে পড়ার মাদ্ধমে শিক্ষার্থীর অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে আর শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে আত্মনির্ভরশীল।

২। তথ্যের সহজলভ্যতা:
বই জ্ঞানের ভান্ডার, যে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় বই পড়ার মাদ্ধমে। কিন্তু এখন প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য মোটা মোটা বই পড়ার প্রয়োজন হয় না। ছোট্ট একটা ক্লিকই সমস্ত তথ্য চোখের সামনে এনে দিতে পারে। মোটা মোটা বই এর ভারী ব্যাগ নিয়েও এখন সমস্যায় পড়তে হয় না শিক্ষার্থীদের, কারণ কম্পিউটার সকল প্রয়োজনীয় তথ্য জমা করে রাখতে পারে। কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যদি অনেক মোটা মোটা বই পড়তে হয়, তাতে অনেক সময় লেগে যায় যাতে করে শিক্ষার্থীর জানার আগ্রহ কমে যায়। কিন্তু সেই একই সমাধান যদি মাত্র কয়েক সেকেন্ডে পাওয়া যায় তখন শিক্ষার্থীর জানার আগ্রহ বেড়ে যায়, তারা আরো জানতে আগ্রহী হয়।

৩। পড়াশুনাকে আনন্দময় করে তোলে:
মোটা কালির লেখা বেশিক্ষণ পড়তে কার ভালো লাগে। কিন্তু সেই একই লেখা যদি সুন্দর সুন্দর ছবি আর ভিডিওর মাদ্ধমে তুলে ধরা হয় তাহলে যে কেউই তা পড়তে বা শিখতে আগ্রহী হবে। বিশেষ করে শিশুরা এই ভাবে পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এভাবে পড়াশুনা করলে তা যেমন পড়ার আগ্রহ বাড়ায় তেমন মনোযোগীও করে তোলে। বই এর একই পড়া অনেক বার পরেও ভুলে যাওয়ার রোগ যাদের আছে তাদের জন্য ইন্টারনেট এ ভিডিও বা কোনো ছবি পড়া মনে রাখার একটি দুর্দান্ত উপায়। এভাবে পড়াশুনা করলে পড়াশুনাকে আর একঘেয়েমি মনে হয় না বরং পড়াশুনা হয়ে উঠে আনন্দময়।

৪। জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে:
আমরা ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাবা মা এর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি, আমাদের শিক্ষার শুরুই হয় বাবা মা এর হাত ধরে। এ সময় আমরা তাই শিখি যা বাবা মা জানে বা তারা আমাদের যে ভাবে শিখায় আমরা সে ভাবেই শিখতে বা বিশ্বাস করতে শুরু করি। আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষের ধর্ম নির্ধারিত হয় জন্মসূত্রে। অর্থাৎ বাবা মা আমাদের যে ধর্মে বিশ্বাস করতে শেখায় আমরা তাই বিশ্বাস করি। কিন্তু একটা সময় যখন মনে অনেক রকম প্রশ্ন জাগে তখন আমরা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাই না। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাদ্ধমে মানুষের এই সব জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করা সম্ভব। বাবা মা এর বিশ্বাসকে সম্মান করে নিজের বিশ্বাস এর প্রতি আস্থা অর্জন করার জন্য জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। না জেনেই অন্ধবিশ্বাস দূর করতে প্রয়োজন প্রযুক্তির সাহায্য, আর এই সাহায্য মনের জানলা খুলে দিয়ে নিয়ে যেতে পারে জ্ঞানের সমুদ্রে।
৫। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবার জন্য উপকারী:
শিক্ষার্থীকে শেখানোর জন্য একজন শিক্ষকেরও অনেক কিছু জানার প্রয়োজন হয়। একজন সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষই পারে শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব পালন করতে। আর এ জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয় নানান তথ্য, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী শিক্ষা দেওয়ার জন্য একজন শিক্ষকের নানা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয় যার জন্য প্রযুক্তির সাহায্য অনিবার্য। বিরক্তিকর একঘেয়েমি ক্লাস থেকে বের করে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে এখন স্মার্ট ক্লাসের প্রচলন শুরু হয়েছে যা প্রযুক্তির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।

৬। শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের জন্য তৈরী হতে পারে:
প্রযুক্তির ব্যবহার জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। ভবিষ্যতে যখন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে তখন তারা ঘাবড়ে যাবে না, তারা ভয় পাবে না, নতুন করে শিখতে হবে না কম্পিউটার, মোবাইল বা অন্যায় ইলেক্টনিক ডিভাইসের ব্যবহার। তারা এখনই এসব বিষয় দক্ষতা অর্জনের মাদ্ধমে নিজেদের ভবিষ্যতের কর্মজীবনের জন্য তৈরী করতে পারবে।
প্রযুক্তির ব্যবহার করে এখন পড়াশুনার মান যেমন উন্নত হচ্ছে তেমন এই প্রযুক্তির ব্যবহার পড়াশুনার ক্ষতির কারণ হিসেবেও চিহ্নিত হচ্ছে কখনো কখনো। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার না করার কারণে এই প্রযুক্তিই এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার সময় নষ্টের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে সচেতন হতে হবে সবাইকে। বাবা মাকে সন্তানের প্রতি নজর রাখতে হবে যেন সন্তান প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে পারে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে করেছে অনেক উন্নত। আমাদের উচিত প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাদ্ধমে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে তৈরী করা যেখানে শিক্ষার্থীরা মা বাবার ভয়ে নয় নিজের ইচ্ছায় পড়াশুনার প্রতি আগ্রহী হবে। তারা শিখবে মনের আনন্দে, শিক্ষকের চোখ রাগানোর ভয়ে নয়। ক্লাসরুম হয়ে উঠবে জ্ঞান আর আনন্দ লাভর জায়গা, ঘুম ঘুম একঘেয়ে লেকচারের জায়গা নয়।
You must be logged in to post a comment.