একজন কিশোর কুমার দাশের জীবনযুদ্ধ এবং বিদ্যানন্দের জন্ম…
চ্যারিটি নামক মানবিকতার শতভাগ প্রয়োগ করে বর্তমানে সমাজসেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা বাংলাদেশের যে ফাউন্ডেশনটি রীতিমত আপামর জনসাধারণের মন জয় করে নিয়েছে তার নামটি বোধকরি আপনাদের কারও অজানা নেই। হ্যা ঠিক ধরেছেন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনটির কথাই বলছি। যারা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সাহায্যকৃত অর্থায়নে পথশিশুসহ হতদরিদ্র-অসহায়দের খাদ্য সেবা প্রদাণ, চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা, জামা-কাপড় কিনে দেয়া, স্কুল পরিচালনা সহ নানাবিধ সমাজসেবার কাজ সম্পাদন করে শুধু দেশে নয় বরং দেশের গন্ডি পেরিয়ে আজ দেশের বাইরেও প্রশংসীত।
ইন্টারনেট ও মিডিয়ার কল্যাণে আজ মোটামোটি আমরা সবাই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে চিনি, এর ব্যাপারে নূণ্যতম ধারণা হলেও রাখি কিন্তু এর পিছনের মানুষটাকে যিনি এর রূপকার, যিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সেই মহামন মানুষটিকে আমরা কয়জন ই বা চিনি, তার সম্পর্কে কয়জন ই বা জানি? আজ তাই চেষ্টা করা হবে এই মহৎপ্রাণ মানুষটার সম্পর্কে আপনাদের কিছু ধারণা দেয়ার।
কিশোর কুমার দাশ,
দারিদ্রতার কষাঘাতে শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তিলে বাড়তে থাকা মানুষটা তার মত কষ্টে থাকা মানুষগুলোর জন্যে আজীবন কিছু করতে চেয়েছেন। প্রাইমারি পর্যায়ে পড়াশুনায় একদম শেষের সারির শিক্ষার্থী থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে পরিণত করা এবং তা থেকে ধাপে ধাপে সাফল্য নিয়ে বিদেশী নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানী তে যোগ দিয়ে দেশে এবং পরে পেরুতে ৭ বছরে বিলাসী জীবনযাপনের পরও জীবনের অর্থ খুঁজতে থাকেন। সেই বিভীুষিকাময় শৈশব থেকে পরিণত সফল পুরুষে পরিণত হওয়া মানুষটা একসময় বিদ্যানন্দের মাধ্যমে তার জীবনের পরিপূর্ণতা পাওয়ার অর্থ খুঁজে পান।
এ পুরো ব্যাপারটা কিন্তু এত্ত সহজেই হয়নি। এর পিছনে আছে জানা-অজানা অনেক গল্প, অনেক আত্বঃত্যাগ, পরিশ্রম, কষ্টের সংগ্রাম, ব্যর্থতার গ্লানি, প্রিয়জন হারানোর কষ্ট।
শৈশব ও কৈশোরঃ
নারায়ণগঞ্জে জন্ম হলেও পিতার কর্মক্ষেত্রের জন্য ছোট বেলা থেকেই পুরো পরিবার সহ বসবাহ চট্টগ্রামের কালুর ঘাটে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা, শৈশব-কৈশোর কাটানো। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য়। পিতা সরকারি তৃতীয় শ্রেণীর একজন কর্মকর্তা বিধায় অভাব অনটন সবসময় লেগেই থাকতো। একবেলা খেলে পরের বেলা খাওয়া হবে কি না চুলায় খাবার না উঠা পর্যন্ত নিশ্চয়তা দেয়া যেত না। একবেলা খেয়ে আরেকবেলা না খেয়ে চলতে থাকা জীবনে ছিল বঞ্চনা, অসহায়ত্ব।এছাড়া সব আত্বীয়-স্বজন ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ায় আপনজন কেউ সেখানে না থাকায় পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে পরার অবস্থা।
খাবারের এত কষ্ট পেয়েছেন তিনি যে ধর্মীয় উপাসনালয় গুলোতে যখন খাবার দেয়া হতো অভাবীদের, ফকির-মিসকিনদের, ছোট্ট কিশোর দাঁড়িয়ে যেতেন লাইনে। কখনও কখনও ১-২ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও শেষ এ খাবার না পেয়ে তাকে অভুক্ত পেট নিয়েই খালি হাতে ফিরে যেতে হয়েছে। রাস্তায় যখন হাঁটতেন তখন কেউ ভালো কিছু খেলে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন যদি দয়া করে তাকে কিছু দেয়া হয়! তিনি জানতেন হয়তো দিবে না, তাও কোন এক আশায় যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা।
ছোটবেলা থেকেই নানা শরীরি প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে একা একাই ঘরে থেকে মানুষ হয়েছেন তিনি। তেমন কোনো বন্ধুও ছিল না। ৭ জনের সংসারে বেশ গাদাগাদি করেই ঘুমাতে হতো তাদের।
প্রত্যেকটা মানুষকে যদি বলা হয় তুমি সুযোগ পেলে জীবনের কোন অংশে ফিরে যেতে চাও? সবাই বিনা সংকোচে বলবে শৈশবে, কিন্তু কিশোর এর শৈশব স্মৃতি এত্ত ক্ষুধার জ্বালা, অসহায়ত্ব, বঞ্চনা আর অবহেলায় ঘেরা যে সে ওই জীবনে কখনও ভুল করেও ফিরতে চায়না।
শিক্ষা জীবনঃ
অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় পরিবারের পক্ষে কিশোরকে পড়াশুনায় সাহায্য করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। এছাড়া কানে কম শোনা এবং দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা থাকার কারণে ক্লাসে পড়াও বুঝতে ব্যাপক সমস্যা হতো তার।
প্রতিনিয়ত করতেন খারাপ রেজাল্ট। এমনকি ৬-৭ বিষয়েও ফেল করাটা তার জন্যে সাধারণ ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল! এছাড়া শারীরিক এসব অক্ষমতার কারণে স্কুলের অন্যান্য বেশিরভাগ সহপাঠীও তাকে ভালভাবে গ্রহণ করতো না। কালুরঘাটেই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পড়াশুনা চলে তার।
আচমকাই প্রাথমিক স্কুল জীবনের পর তিনি খেয়াল করলেন তার প্রতিবন্ধকতা কমে আসছে। কান ও চোখের সমস্যা ঠিক হোতে শুরু করেছে! পড়াশুনায় যে ছেলে শেষের সারিতে ছিল সে এখন সব বিষয়ে ভালো করা শুরু করেছে। গণিতে ৯০-৯৫ করে নাম্বার পাচ্ছে। জীবনে এ যেনো এক নতুন উদ্দোম পেলেন তিনি।
সময়ে অসময়ে পড়াুশোনা অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এক বন্ধুর সাহায্যে পড়াশুনার কিছু খরচ চালিয়ে নিতেন, অন্যদিকে তার এক শ্রদ্ধেও শিক্ষক ভর্তির ব্যাপারে সহায়তা করে তাকে টেনে তুলার চেষ্টা করেন। অর্থাভাবে এস.এস.সি এর পর দুই বছর পড়াশুনা বন্ধও থাকে তার। টিউশন করিয়ে অর্থ উপার্জন করে ইন্টার এর পড়াশুনা চালান, ভালো ফলাফলও করেন।
কষ্ট, সংগ্রাম আর মেধার স্বাক্ষর রেখে ২০০১ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এ।
কর্মজীবনঃ
চুয়েট থেকে পাস করে বের হয়ে তিনি অনুধাবন করেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিবাবের হাল ধরতে হবে। আর এজন্য পিয়ন,দারোয়ান এর পোস্ট থেকে শুরু করে একদম সর্বোচ্চ পোস্ট এর জন্যে তিনি আবেদন করা শুরু করেন। আবেদনের ব্যাপারে বিন্দিমাত্র বাছ-বিচার করেন নি।
২০০৬ সালে বিডি কম অনলাইন লিমিটেড নামক কম্পানি দিয়ে শুরু হয় তার কর্মজীবন। কাজে সুনিপুন দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তিনি সুনাম কুড়াতে থাকেন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন জাপানিজ কম্পানী ছাড়াও এয়ারটেল এর উর্ধ্বোতন পদে কয়েক বছর কর্মরত ছিলেন। ধাপে ধাপে উন্নতি করতে করতে শেষে এক সুপ্রতিষ্টিত বিদেশী মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে উর্ধ্বোতন পদে আসীন হন এবং OLO del peru S.A.C কম্পানির অফারেই পেরু গমন করেন। বর্তমানে ৭ বছর ধরে অবস্থান করছেন পেরুতেই। এমনকি গুগলের সাথে কোলাবরেশনে তিনি Cloudeare360 SAC এর কমার্শিয়াল ডিরেক্টর এর দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়া উদ্যোক্তা হিসেবেও কাজ করার দক্ষতা দেখান, পান সফলতা।
আত্মহত্যা প্রবণতাঃ
এ নিয়ে জীবিনে দু বারের মত আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কিশোর। প্রথমবার অভাবের তাড়নায় যখন তিনি সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। আরেকবার চেষ্টা করেন যখন প্রচুর অর্থ সম্পদ থাকার পরেও তিনি জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলেন না ঠিক তখন। শৈশবের ক্ষুধার জ্বালা, পরিণত বয়সে প্রাক্তণ প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ তার জীবনকে অসহায় করে তোলে। জীবনটা ঠিক যেন দিনের বেলায় একজন সফল মানুষ, রাতের বেলায় একাকীত্ব এর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া অন্য কেউ। এ বিষয়গুলো প্রতিনিয়তই যেন তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিতে থাকে।
আত্ব-উপলব্ধি থেকে বিদ্যানন্দের জন্মঃ
দু দু বার আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে কিশোর নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন। ” এই যে মরে গেলাম, সেটা তো চাইলেই পারি কিন্তু আমি জীবনে অন্যের জন্য কি করে গেলাম? প্রাপ্তি কি? জীবনের উদ্দেশ্য কি? এত টাকা উপার্জন করেই বা কি লাভ হলো! টাকাগুলোর তো সৎ গতি করে যাওয়া দরকার।
নিজে যখন অন্যের দেয়া খাবার খেয়েছেন, ঠিক তখন ই ভেবেছিলেন অন্যরা যারা তার মত ক্ষুধার জ্বালায় কাতর, পড়াশুনা করার সুযোগ পায়না তাদের নিয়ে কিছু করবেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বোকারাই সমাজ পরিবর্তন করে, ভালো কাজে এগিয়ে আসে, আর চালাকেরা শুধু নিজের উন্নতি নিয়ে ভাবে।
এরকম একজন বোকা মানুষ তার দিদি শিপ্রা দাশকে সাথে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে মাত্র পাঁচটি সুবিধা বঞ্চিত মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় বিদ্যানন্দের পথচলা। কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নয় বরং ক্ষুধার্থকে একবেলা খাওয়ানোর আনন্দ থেকে ২০১৩ সাল থেকে বিদ্যানন্দ এর সৃষ্টি। একে একে তাদের কাজের মধ্য দিয়ে জয় করতে থাকে মানুষের মন, বাড়তে থাকে কাজের পরিসর। আস্তে আস্তে ১২ টির বেশি শাখা ছড়িয়ে পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রংপুর, রাজবাড়ি, রাজশাহী সহ দেশের আরও অনেক স্থানে।
কিশোর প্রথম ১.৫ বছর নিজেই অর্থের জোগান দিলেও কাজের পরিধি বিশাল হয়ে যাওয়ায় এখন পুরোপুরি দেশের জনসাধারণের অনুদানেই বিদ্যানন্দের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
শিক্ষা ও খাদ্য সহায়তা মূল মন্ত্রে রেখে ১ টাকায় আহার, ১ টাকায় সুবিধা বঞ্চিতদের চিকিৎসা সহায়তা, অসহায় বাচ্চাদের ১ টাকায় কাপড় এর ব্যবস্থা করা, স্কুল-পাঠাগার, এতিমখানা স্থাপন, ডে কেয়ার সুবিধা সহ নবজাতক মায়েদের জন্যে গার্মেন্টস, ছিন্নমূল বাচ্চাদের পোশাকের ব্যবস্থা ইত্যাদি কর্মকান্ড শুরু হয়।
বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে অভাবগ্রস্থ হাজারো মানুষের দুয়ারে খাদ্য পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে জনসাধারণের ভূয়সী প্রশংসায় সম্মানিত হয়েছে বিদ্যানন্দ। সবার প্রত্যাশা এভাবেই বিদ্যানন্দ তাদের মানবতার আলো ছড়িয়ে যাবে, দেশকে করবে আলোকিত।
The Post is Written By Akash Manzur. He is a Civil Engineering Final Year Student of CUET.
You must be logged in to post a comment.