পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনঃ মাতৃত্বের বিষণ্ণতা
নতুন একটি শিশুর জন্ম প্রতিটি পরিবারেই বয়ে আনে আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। নবজাতকের আগমন বাবা মায়ের জীবনের অনেক বড় উপহার। অনেক ক্ষেত্রেই মাতৃত্বকে নারীর জীবনের পরিপূর্ণ রূপ হিসেবে মনে করা হয়। এ কারণে স্বাভাবিক ভাবেই মাতৃত্বকে নারীর জীবনের অন্যতম সুখকর অভিজ্ঞতা বলা যেতেই পারে।
কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, বাস্তবে এই স্বাভাবিক চিত্রের বিপরীত ঘটনাও ঘটে থাকে। মাতৃত্বের আনন্দ কখনো কখনো হতাশা বা বিষণ্ণতার রূপ নিতে পারে। সারা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি নতুন মায়ের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা কম বেশি হয়ে থাকে। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান জন্মদান পর্যন্ত একজন নারীর শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তন হয়ে থাকে। যার ফলে শিশু জন্মের পর প্রায় এক দেড় মাস মায়ের মাঝে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ক্লান্তি, হতাশা বা খিটখিটে মেজাজ দেখা যায়। কিন্তু এধরণের লক্ষণ গুলো যখন এক দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান থাকে এবং সময়ের সাথে সাথে গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়, তখন তাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা বলা হয়।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনকে অনেক সময়ই বেবি ব্লুজ বা সাধারণ বিষণ্ণতা ভাবা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন আরো গুরুতর একটি বিষয়। WHO (World Health Organization) এর ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে ১০% গর্ভবতী মহিলা এবং ১৩% নতুন মায়েদের মাঝে বিষণ্নতা দেখা যায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ হার আরো বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ হার প্রায় ১৯.৮%। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মায়েরা শিশুর ঠিকমত যত্ন বা দেখাশোনা করতে পারে না। যার ফলে শিশুর সঠিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ:
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো সাধারনত দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। প্রসব–পরবর্তী বিষণ্ণতা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সন্তান জন্মদানের আগে থেকেই অর্থাৎ গর্ভাবস্থায়ই মায়ের মাঝে বিষণ্ণতার কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে এবং তা সন্তান জন্মদানের পরে সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন মায়ের মাঝে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ গুলো দেখা যায়। নতুন মায়েদের মাঝে এ হার কিছুটা বেশি।
লক্ষণ সমূহ-
- ইনসমনিয়া (ঘুমের সমস্যা)
- অতিরিক্ত ঘুমানো
- খিটখিটে মেজাজ
- হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া
- প্যানিক অ্যাটাক
- নবজাতকের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে না পারা
- একদমই খেতে না পারা কিংবা অতিরিক্ত খাওয়া
- পছন্দের জিনিসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
- কোন কাজেই মনোনিবেশ করতে না পারা
- কোন কারণ ছাড়াই ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন হওয়া
- কারণ ছাড়াই দুঃখ বোধ এবং কান্নাকাটি করা
- ”আমি ভালো মা নই” ঘন ঘন এরকম অনুভূতি হওয়া
- নিজেকে নিয়ে বিব্রত ও লজ্জিতবোধ করা
- কোন বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে না পারা
- ”নিজের কিংবা সন্তানের কোন ক্ষতি করে ফেলতে পারি” সবসময় এমন চিন্তাভাবনা করা
- আত্মহত্যার কথা চিন্তা করা
এসকল উপসর্গের সবগুলো কিংবা বেশ কয়েকটি যদি নতুন মায়েদের মাঝে দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে তারা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগছেন। দেরি না করে তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।
শুধুমাত্র মায়েদেরই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হয়ে থাকে তা কিন্তু নয়। অনেকক্ষেত্রে নতুন বাবারাও পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন। কম বয়স, পূর্বে বিষণ্ণতার ইতিহাস, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ইত্যাদি কারণে নতুন বাবাদের মাঝেও ডিপ্রেশনের লক্ষণ দেখা যেতে পারে। যদিও এ হার খুবই কম।
আমাদের দেশে প্রসব পরবর্তী মায়ের আচরণের পরিবর্তনকে অনেকেই সহজ ভাবে নিতে পারে না। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনকে যতটা না মানসিক সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, তার চেয়ে বেশি আচরণিক সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। পরিবার ও আশেপাশের মানুষ এর মাঝে যদি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকে তাহলে মায়ের জন্য আরো খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। “আমি হয়তো ভালো মা নই“, “আমি আমার বাচ্চার ক্ষতি করে ফেলতে পারি” এধরণের চিন্তাভাবনা থেকে ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা মায়ের মাঝে নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা চলে আসতে পারে। পারিপার্শ্বিক নেতিবাচক চিন্তাভাবনা মায়ের বিষণ্ণতাকে আরো গুরুতর পর্যায়ে নিয়ে যায়। এ কারণে আমাদের আসলে বুঝতে হবে যে, পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন মোটেও কোন চারিত্রিক সমস্যা নয়; নতুন একটি প্রাণকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে একজন মায়ের যে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিরর্তন হয়ে থাকে, হরমোনের পরিবর্তন হয়ে থাকে তার কারণেই মায়ের মাঝে এ ধরণের বিষণ্ণতা দেখা দেয়। পরিবার সবসময়ই সবার কাছে অনেক বড় আস্থার জায়গা। তাই এসময় পরিবারের সবার নতুন মাকে সাহায্য করা উচিৎ এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নিয়ে ঘাবড়ে যাওয়ার বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ সম্পর্কে সচেতন থাকলে, পরিবার থেকে সহযোগিতা পেলে এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা পেলে ডিপ্রেশন থেকে দ্রুতই বের হয়ে আসা সম্ভব।
You must be logged in to post a comment.